রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২০ অপরাহ্ন

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট তুরস্ক?

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের পর এবার ইসরায়েলের টার্গেট হতে পারে তুরস্ক। গত সপ্তাহে কাতারের ওপর ইসরায়েলের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশটির ঘনিষ্ঠ সমর্থকরা এবার দৃষ্টি ঘুরিয়েছে তুরস্কের দিকে। ওয়াশিংটনে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল রুবিন সতর্ক করে বলেছেন, তুরস্ক হতে পারে ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য এবং দেশটির ন্যাটো সদস্যপদকে রক্ষাকবচ মনে করলে ভুল হবে।

একইসঙ্গে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ মেয়ার মাসরি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, আজ কাতার, কাল তুরস্ক। এর জবাবে তুরস্ক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের এক শীর্ষ উপদেষ্টা কঠোর ভাষায় বলেন, জিয়োনিস্ট ইসরায়েলের কুকুর… শিগগির তোমাদের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হবে, তখনই বিশ্ব শান্তি পাবে।

গত কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলপন্থি সংবাদমাধ্যমগুলো তুরস্ককে ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরছে। বিশ্লেষকদের মতে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের উপস্থিতি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া পুনর্গঠনে ভূমিকা তেলআবিবকে বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছে।

ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতি অব্যাহত থাকা ও গাজায় যুদ্ধ শেষ না হওয়ায় গত আগস্টে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করেন।

আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট ফেলো ওমের ওজকিজিলচিক বলেন, আঙ্কারায় এ ধরনের ইসরায়েলপন্থি বক্তব্য খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। তুরস্ক মনে করে, ইসরায়েল আঞ্চলিক আধিপত্য চাইছে এবং এতে মার্কিন সমর্থন রয়েছে।

কাতারে ইসরায়েলের হামলা আঙ্কারার ন্যাটো মিত্রদের ওপর আস্থা আরও কমিয়ে দিয়েছে। কারণ কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রধান অ-ন্যাটো মিত্র’ হলেও ওয়াশিংটন কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এতে প্রশ্ন উঠেছে-তুরস্কের ওপর হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কি ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫ প্রয়োগ করবে?

ওজকিজিলচিক বলেন, তুরস্ক অনেক আগেই বুঝে গেছে যে, তার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না।

এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে তার দেশের আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদী লক্ষ্য নিয়ে বড়াই করছেন। আগস্টে তাকে যখন ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণায় বিশ্বাস করেন কি না জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বলেন, অবশ্যই।

তুরস্কের জন্য এটি কেবল প্রতীকী নয় বরং সরাসরি ইঙ্গিত যে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, যা আঙ্কারার আঞ্চলিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়তে পারে।

হাকান ফিদান আল জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলের এই ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ দর্শন-যা কিছু ধর্মীয় জিয়োনিস্টদের মতে আধুনিক সিরিয়া, লেবানন, মিশর ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা আসলে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে দুর্বল ও বিভক্ত রাখার পরিকল্পনা।

শুধু গাজা নয়, গত কয়েক সপ্তাহেই ইয়েমেন, সিরিয়া, এমনকি তিউনিসিয়ায় গাজা সহায়তা বহরে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রেক্ষাপটে তুরস্ক ও ইসরায়েল এরই মধ্যে ‘ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা’-তে জড়িয়ে পড়েছে।

আঞ্চলিক আধিপত্যের খেলা
গত জুলাইয়ে তুরস্কে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও সিরিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত টম ব্যারাক স্বীকার করেন যে, ইসরায়েল বিভক্ত ও দুর্বল সিরিয়াকেই পছন্দ করে।

গত ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ায় ডজনখানেক হামলা চালিয়েছে এবং কিছু এলাকা দখল করেছে। ২০২৪ সালে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের বড় অংশকে হত্যা করেছে ও লেবাননের কিছু এলাকা এখনো দখলে রেখেছে।

চলতি বছরের জুনে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায় এবং যুক্তরাষ্ট্রও এতে জড়িয়ে পড়ে। এতে ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা নিহত হন। বিশ্লেষকদের মতে, এর উদ্দেশ্য ছিল তেহরানের সামরিক ও পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল করা এবং শেষ পর্যন্ত শাসন পরিবর্তনের চাপ বাড়ানো।

তুরস্ক এখন ইসরায়েলের জন্য সম্ভাব্য পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সিরিয়ায় তুরস্ক নতুন সামরিক ঘাঁটি গড়তে চাইলে ইসরায়েল আপত্তি জানাচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত তুর্কি অ্যাডমিরাল সেম গুরডেনিজ সতর্ক করে বলেন, তুরস্ক-ইসরায়েল সংঘর্ষের প্রথম দৃশ্য দেখা যেতে পারে সিরিয়ার আকাশে বা মাটিতে।

তিনি আরও বলেন, সাইপ্রাসে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি এবং গ্রিস ও গ্রীক সাইপ্রিয়টদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যে জোট গড়ছে, তা আঙ্কারার কাছে স্পষ্টতই ঘেরাও কৌশল।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় নেতাদের বলেছেন, স্থিতিশীল সিরিয়া হতে হলে তা অবশ্যই ‘ফেডারেল’ কাঠামোর হতে হবে। কিন্তু তুরস্ক নতুন দামেস্ক প্রশাসনের কেন্দ্রীভূত একক রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করে।

রেড লাইন এবং সংঘাতের ঝুঁকি
নেতানিয়াহু এখন সিরিয়াকে জাতিগত ও ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত করতে চাইছে। এতে দেশটির দ্রুজ, কুর্দি ও আলাওয়ি সম্প্রদায়গুলো নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে পারে, যা গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে।

সেটা তুরস্ক কোনোভাবেই মেনে নেবে না বলে জানিয়েছেন সেতা থিংক ট্যাঙ্কের পররাষ্ট্রনীতির পরিচালক মুরাত ইয়েসিলতাস। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আঞ্চলিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভাঙন আরও গভীর করবে।

এছাড়া ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএনএসএস) গত মার্চে এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, তুরস্ক ও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) মধ্যে উদীয়মান শান্তি প্রক্রিয়া সিরিয়ার কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দুর্বল করতে পারে এবং তুরস্ককে দক্ষিণ সিরিয়ায় আরও প্রভাবশালী করে তুলতে পারে, যা ইসরায়েলের জন্য হুমকি।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ স্পষ্ট করে বলেছেন, দক্ষিণ সিরিয়ার দখলকৃত এলাকা ‘অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য’ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

তুরস্ক যখন হোমস ও হামার বিমানবন্দরে সামরিক ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা করছিল, ইসরায়েল সেই স্থানগুলোতে বোমা হামলা চালায়। ইয়েসিলতাস সতর্ক করে বলেন, যদি তেলআবিব এই পথেই এগোতে থাকে, আঙ্কারা-তেলআবিব সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়বে।

তবে লন্ডনের কিংস কলেজের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেয়াস ক্রিগ মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ সংঘাত অবশ্যম্ভাবী নয়। তার মতে, ইসরায়েলের হুমকি সরাসরি সামরিক আগ্রাসন নয় বরং তুরস্কের স্বার্থকে পরোক্ষভাবে আঘাত করা।

তিনি পরামর্শ দেন, আঙ্কারার উচিত কৌশলগত প্রতিরোধ শক্তি বাড়ানো বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সক্ষমতা উন্নত করা এবং কাতার, জর্ডান ও ইরাকের সঙ্গে আঞ্চলিক জোট গড়ে তোলা। একইসঙ্গে ওয়াশিংটনের সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ত রাখা জরুরি যেন কৌশলগত বিচ্ছিন্নতা এড়ানো যায়।

টিটিএন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024